ডাক্তার আব্দুস শুকুর রঞ্জনঃ আজ ৯ ডিসেম্বর//সাঁথিয়া মুক্ত দিবস;; দেশপ্রেমে জাগ্রত হোক ঘুমন্ত হ্নদয়; উদ্ভাসিত হোক ভালবাসার আপন শক্তিতে
সাল ১৯৭১! যুদ্ধের দামামা চলছে প্রায় বছর জুড়ে! শেষ মাস ডিসেম্বরে এসে মরণ কামড় দিয়েছিল পাক বাহিনী! পাল্টা প্রতিরোধের দেয়াল পেরিয়ে যুদ্ধ জয়ের সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছিল! কিন্তু এই বিজয়টা মোটেই সহজ ছিল না! পুরো বছর জুড়ে জীবন বাজি রেখে লড়াই করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ সব সময়ই ছিল ঠোঁটের আগায়! প্রিয় জন্মভূমি সাঁথিয়ার সুর্য সন্তানেরাও কম যান নাই! একাত্তরের ১৯ এপ্রিল শহীদ নগর পূর্বের নাম ডাববাগানের ভয়াল লড়াইয়ে ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারাণ, ১৪ মে উপজেলার ধুলাউড়ির বাউশগাড়িতে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়, ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়ি ফকিরবাড়িতে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে পাক বাহিনী আর এই লড়াইয়ে এক শতাধিক গ্রামবাসীকে পুড়িয়ে, গুলি করে বা বেয়নেট দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে হত্যা করে! নির্মমতার কি ভয়ংকর থাবা যা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে আর কল্পনা করেও বাস্তবতা বুঝা যাবে না যে কি পরিমাণ রক্তের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় সাঁথিয়া তথা পুরো বাংলাদেশ! যুদ্ধের দশ মাসে সাঁথিয়ার কি যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল তা এরকম ২/৩ দিনের ঘটনাবলী হতেই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে! ডিসেম্বরের ৭ তারিখে বীরমুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়ায় প্রবেশের তিনটি ব্রিজ ও কালভার্ট বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়। যাতে পাকিস্তানী সেনারা গাড়িবহর নিয়ে সাঁথিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে অন্যদিকে বীরমুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের নিচে বাঙ্কার তৈরি করে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে চরম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বীরমুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পাকিস্তানী সেনারা ক্ষতিগ্রস্ত দুটি গাড়ি ফেলে পিছু হটে। পরদিন ৮ ডিসেম্বর সাঁথিয়া প্রবেশের পথে আবারো বীরমুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে বিকেলের দিকে পিছু হটে পাকিস্তানী সেনারা। এই লড়াইয়ের পুরো সময় সাঁথিয়ার একমাত্র নারী যোদ্ধা ভানু নেছা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থানা থেকে অস্ত্র ও গোলা বারুদ বীরমুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। এ দিকে ৯ ডিসেম্বর বীরমুক্তিযোদ্ধারা সাঁথিয়া থানা দখলে নেয়। ওই দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে সাঁথিয়া থানায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়! মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পায় সাঁথিয়া, মুক্ত হয় জন্মভূমি, জন্ম হয় স্বাধীনতার!
দিগন্ত বিস্তৃত এই বিশাল সবুজের মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের বৃত্তেই সেদিন আঁকা হয়েছিল আজকের লাল সবুজ পতাকা!
যে সুর্য সন্তানদের বীরত্বগাঁথায় রচিত হয়েছে এই বীরত্বকাব্য সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধকালীন উপজেলা কমান্ডার মরহুম মোঃ নিজাম উদ্দিন, বর্তমান কমান্ডার মোঃ আব্দুল লতিফ, রাবির ছাত্র নেতা ফজলুল হক, মরহুম মকবুল হোসেন মুকুল, মরহুম লোকমান হোসেন মাষ্টার , রেজাউল করিম, আলতাব হোসেন, আবু মুসা, আবু হানিফ, মোসলেম উদ্দিন, তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুল ওহাব, সোহরাব, রউফ, মতিন, একমাত্র মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ভানু নেছা সহ অনেকেই অন্যতম নাম জানা ও নাম না জানা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রইল হ্নদয় হতে উৎসারিত শ্রদ্ধাবনত ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা! আপনারা জন্মেছিলেন বলেই আমরা আজ বেঁচে আছি!
দীর্ঘ ৯ মাস সাঁথিয়ার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে বীরমুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, নজরুল ইসলাম (চাদু), আব্দুস সামাদ, দারা হোসেন, শাহজাহান আলী সহ অসংখ্য নিরীহ মানুষ শহীদ হন। এছাড়াও শহীদ হোন প্রায় ৪ শতাধিক বেসামরিক ব্যক্তি!
যুদ্ধকালীন সময়ে নিঁখোজ হয়েছেন আহমদ ছগীর (বাঘা) সহ নাম না জানা আরো অনেকেই যাদের পথ পাণে চেয়ে চেয়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন তাদের বৃদ্ধ মা-বাবা আর প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী! তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সেইটা জানার সৌভাগ্যও তার প্রিয় জনদের কপালে জোটেনি! হে আল্লাহ, যুদ্ধ কালীন সময়ে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন এবং যুদ্ধ উত্তর হতে অদ্যাবধি যে সকল বীর সন্তান দুনিয়া হতে চির বিদায় নিয়েছেন তন্মধ্যে মরহুম নিজাম উদ্দীন, মোঃ রুস্তম আলী মাষ্টার , মোজাম্মেল হক মাষ্টার, মোঃ মোসলেম উদ্দিন, প্রিয় শিক্ষক লোকমান হোসেন, মকবুল হোসেন মুকুল, হারুনুর রশিদ মাষ্টার সহ নাম না জানা সকল মুক্তিকামী সন্তানদের তুমি পরকালীন মুক্তি দান কর, দেশ মাতৃকায় জীবন বাজি রাখার জন্য তাদের সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌসে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত কর এছাড়া একমাত্র মহিলা মুক্তি যোদ্ধা ভানু নেছা গুরুতর অসুস্থ, জীবন মৃত্যুর সন্নিকটে অজ্ঞান অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন! হেঁ প্রভু, তিনি সহ যে সকল মুক্তিযোদ্ধারা শারীরিক ভাবে অসুস্থ তাদেরকে শারীরিক সুস্থতা দান কর, তাদের দীর্ঘ জীবন দান কর, সাঁথিয়া সেবায় অব্যাহত কাজ করার সুযোগ দান কর বর্তমান প্রজন্মের উচিৎ, পূর্বসুরীদের দেখানো সেই ত্যাগ ও তিতিক্ষার রক্তমাখা সোপান গাঁথা পেরিয়ে ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জন করার বীরত্ব পুর্ণ ইতিহাসকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ ভাবে, মিলেমিশে, হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরনির্ভরশীলতাকে পায়ে পদদলিত করে জন্মভূমির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক বাসযোগ্য আবাসভূমি বিনির্মাণে আত্ননিয়োগ করা আর সেটাই হবে উত্তরসূরি হিসাবে উপযুক্ততার উত্তম নির্ণায়ক ও যোগ্যতার মাপকাঠি!জান্নাত কামনা সকল শহীদের প্রতি আর শুভ কামনা রইল সবার জন্য।