১৭ই জুন, ২০২৫ 🔻 ৩রা আষাঢ়, ১৪৩২🔻 ২০শে জিলহজ, ১৪৪৬

ঢাকা থেকে পাবনা: করোনা পরীক্ষায় জালিয়াতি, ১৩ মামলায় গ্রেফতার ৬১

শেয়ার করুন:

ফাইল ছবি
আমানুর
রহমান রনি:
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় করোনাভাইরাস শনাক্তে নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতির
সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায়
শনিবার (১৮ জুলাই) বিকাল পর্যন্ত অন্তত ৬১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। জালিয়াতির
সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই দ্রুত আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা
বাহিনী।
জালিয়াতি
প্রথম ধরা পড়ে সাভারে
করোনার
নমুনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি কবে শুরু হয়েছে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। তবে গত
৪ জুন সাভার থেকে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর প্রথম জালিয়াতির কথা জানা যায়। সাভারের
ডেনিটেক্স নামে একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের করোনার কয়েকটি নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে
কারখানা কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তারা ওই শ্রমিকদের জেরা করে, তবে তারা কেউ মুখ খুলছিল
না। এরপর বিষয়টি কর্তৃপক্ষ সাভার পুলিশকে জানায়। সাভার পুলিশ শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ
শেষে আবু সাঈদ ও রাজু নামে দুই জনকে সাভারের গেন্ডা এলাকা থেকে আটক করে। তারা পুলিশের
জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সাঈদ এক সময় সাভার উপেজলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চুক্তিভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মী
হিসেবে কাজ করতো। তার একটি ফার্মেসিও রয়েছে। তাদের কাছ থেকেও জাল সার্টিফিকেট এবং সার্টিফিকেট
তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশ।
এই
ঘটনায় সাভার থানায় একটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
(ওসি) এফএম শাহেদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আশুলিয়ার এক বাসিন্দা জাল সনদের বিষয়টি
ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানায়। তবে সেটি আমার এলাকা না হওয়ায় সেখানে অভিযানে যেতে পারিনি।
পরে এই চক্রটিকে গ্রেফতার করি। গ্রেফতার দুজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
তারা জেলহাজতে আছে।’

জেকেজির
বিরুদ্ধে চার মামলা: গ্রেফতার ৩৭ জন
জেকেজি
হেলথ কেয়ারের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রতারণার, দুটি ভাঙচুরের
ও আরেকটি জিনিসপত্র আত্মসাতের। চতুর্থ মামলাটি একজন ব্যবসায়ী করেছেন। ওই ব্যবসায়ীর
ল্যাপটপসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আত্মসাৎ করে জেকেজি। ভাঙচুরের দুই মামলায় ৩৩ জন গ্রেফতার
হয়েছে। প্রতারণার মামলায় জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফুল চৌধুরী, তার স্ত্রী সাবরিনা
আরিফ চৌধুরী এবং প্রতিষ্ঠানটির নার্স তানজিনা পাটোয়ারী ও তার স্বামী গ্রাফিক্স ডিজাইনার
হুমায়ুন কবির হিমুকে আসামি করা হয়েছে।
তেজাগাঁও
থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেন বলেন, ‘আরিফুল চৌধুরীকে গ্রেফতার
করে থানায় নিয়ে আসার পর, তার অনুসারীরা কয়েক দফা থানায় ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনায় দুই
মামলায় ১৮ ও ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এক ভুক্তভোগীর জিনিসপত্র আত্মাসাৎ করায় একটি
মামলা হয়েছে। এই তিনটি মামলা থানা তদন্ত করছে। প্রতারণার মামলা নম্বর-২৩। ডিবি মামলাটি
তদন্ত করছে। জেকেজি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ৩৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
রিজেন্ট
হাসপাতালের ঘটনায় চার মামলা
রিজেন্ট
হাসপাতালের করোনাভাইরাস টেস্ট কেলেঙ্কারির ঘটনায় ঢাকা, সাতক্ষীরা ও কাপাসিয়ায় মোট চারটি
মামলা হয়েছে। র‌্যাব বাদী হয়ে মামলাগুলো করেছে। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায়
করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার একটি, জাল টাকার একটি এবং সাতক্ষীরা দেবহাটা থানায় অস্ত্র
আইনে সাহেদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা
পরিচালক (এমডি) মাসুদ পারভেজের বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে গাজীপুরের
কাপাসিয়া থানায় মামলা হয়েছে। কাপাসিয়া বাজারের জুয়েলারি ব্যবসায়ী চন্দন রক্ষিত শুক্রবার
(১৭ জুলাই) রাতে মামলাটি করেন। রিজেন্টের ঘটনায় র‌্যাব মোট ১২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের
কাছে হস্তান্তর করেছে। এদের মধ্যে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ও
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজ রয়েছে। বর্তমানে তারা গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে
রয়েছে।
মুগদায়
হাসপাতালে জালিয়াতির সঙ্গে ছিল এক আনসার সদস্য
গত
১৫ জুন র‌্যাব-৩ রাজধানীর মুগদা এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় তিন জনের একটি চক্রকে গ্রেফতার
করে র‌্যাব। চক্রটির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জাল সনদ ও সনদ তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

র‌্যাব-৩-এর
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফাইজুল ইসলাম জানান, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের করোনা রোগীদের
সনদের কপি সংগ্রহের পর তা স্ক্যান করে সেখানে অন্য জনের নাম বসিয়ে বিক্রি করে আসছিল
একটি চক্র। যাদের করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট দরকার হতো, জাল সনদ তৈরি করে মোটা অঙ্কের
টাকায় তাদের কাছে তা বিক্রি করতো তারা। এই ঘটনায় মুগদা থানায় র‌্যাব বাদী হয়ে একটি
মামলা করে।
অপরদিকে,
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে আরও একটি জালিয়াতির মামলা করেছে। এই মামলায় হাসপাতালে
দায়িত্বরত একজন আনসারকেও আসামি করা হয়। আনসারসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। এই মামলা দুটি
মুগদা থানা তদন্ত করছে।
মুগদা
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রলয় কুমার সাহা বলেন, ‌‘আমরা
মামলা দুটি তদন্ত করছি। আসামিরা সবাই জেলহাজতে রয়েছে।’ মুগদায় জালিয়াতির ঘটনায় পাঁচ
জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পাবনায়
জালিয়াতি করেছিল দুই প্রতিষ্ঠান
অবৈধভাবে
করোনার নমুনা সংগ্রহ করার অপরাধে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে মেডিকেয়ার ক্লিনিক
এবং অবগ্যান ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা
হয়েছে। দুই মামলায় পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ঈশ্বরদী
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  শেখ মো. নাসীর
উদ্দীন বলেন, ‘নমুনা সংগ্রহ করার অনুমোদন না থাকায় গত ৭ জুলাই রূপপুর
মেডিকেয়ার ক্লিনিকের মালিক আব্দুল ওহাব রানাকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার ক্লিনিকটি
সিলগালা করে দেয় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। হাসপাতালটির ম্যানেজারসহ আরও দুজনকে তখন
গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনায় তিন জন গ্রেফতার আছে। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো
হয়েছে।’
তিনি
বলেন, ‘অপর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যারা নমুনা সংগ্রহ করতে এসেছিল, তাদের দুজনকে
গ্রেফতার করা হয়েছে। অবগ্যান ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হয়ে তারা কাজ করতেছিল। তাদেরও অনুমতি
ছিল না। তাই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। দুটি ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। মামলা নম্বর
১৩ ও ২৩। আমরা মামলার তদন্ত করছি।’

আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর বক্তব্য
র‌্যাব
সবচেয়ে বড় জালিয়াত চক্র রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদকে গ্রেফতার করে
জালিয়াতি চক্রের দুর্গ ভেঙে দিয়েছে। বাহিনীর মিডিয়া ও আইন শাখার পরিচালক লে. ক. আশিক
বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা যখনই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাবো, তখনই জালিয়াত
চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। সাহেদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে আমরা হট লাইন
চালু করেছি।’

এদিকে
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছেন, ‘আমরা জালিয়াতি
ও প্রতারণার নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি। তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের নাম আসবে, তাদের প্রয়োজন
অনুযায়ী আটক, গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’