১৭ই জুন, ২০২৫ 🔻 ৩রা আষাঢ়, ১৪৩২🔻 ২০শে জিলহজ, ১৪৪৬

ভাঙ্গুড়ায় কোটি টাকার প্রকল্পে জালিয়াতি – ইউএনও ও প্রকল্প কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

শেয়ার করুন:

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা-নগদ অর্থ) ও রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর-নগদ অর্থ) কর্মসূচির আওতায় প্রকল্পের নামে কোটি টাকার লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিন তদন্ত ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত ১৪টি প্রকল্পে একটুও কাজ না করেই বরাদ্দের অর্ধেক টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাকি ৪১ টি প্রকল্পের বেশিরভাগেই আংশিক কাজ করে পুরো বরাদ্দের অর্ধেক অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এমন অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. নাজমুন নাহার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফেরদৌস হোসেন এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের পিআইসি ও ইউপি সদস্যদের বিরুদ্ধে। এসব প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার বেশি।

জানা গেছে, সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে এ বছর ভাঙ্গুড়া উপজেলায় কাবিটা-নগদ অর্থ কর্মসূচিতে ১৭টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ৮৬ লাখ ৭ হাজার ৮১৫ টাকা এবং টিআর-নগদ অর্থ কর্মসূচিতে ৩৮ টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ৮৪ লাখ ৭৪ হাজার ৯৭৫ টাকা। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে মোট ৫৫ টি প্রকল্পের মধ্যে ১৪টি প্রকল্পে কোন কাজ না করেই উত্তোলন করা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকারও বেশি। বাকি প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আংশিক কাজ করেই তোলা হয়েছে বরাদ্দের অর্ধেক।

ইউনিয়ন ভিত্তিক প্রকল্প অনিয়মের বিস্তারিত চিত্র:
অষ্টমনিষা ইউনিয়ন: রূপসি ওয়াপদা বাঁধ থেকে নবীরের বাড়ি হয়ে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তার বরাদ্দ ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কাজ না করেই উত্তোলন করা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বড় বিশাকোল ও লামকান জামে মসজিদ সংলগ্ন রাস্তা সংস্কার আংশিক কাজ করে অর্ধেক টাকা উত্তোলন এবং বাঁশের সাঁকো নির্মাণ প্রকল্প সম্পূর্ণ ভুয়া বলে দাবি স্থানীয়দের।

খানমরিচ ইউনিয়ন: তিনটি কাবিটা প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ১৫ লাখ টাকার অধিক। কিছু জায়গায় কাজ হয়নি আবার কিছু জায়গায় কাজ হয়েছে আংশিক। টিআর প্রকল্পের ৮টির মধ্যে ৬টিতে একেবারেই কাজ হয়নি, অথচ বরাদ্দকৃত অর্থের অর্ধেক উত্তোলন করা হয়েছে এবং পুরনো রাস্তার ওপর নতুন প্রকল্প দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

মন্ডতোষ ইউনিয়ন: কাবিটা কর্মসূচির আওতায় ২টি প্রকল্পের ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা এবং টিআর কর্মসূচির ২টি প্রকল্পের ৪ লক্ষ ৬৭ হাজার টাকার কাজে রয়েছে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ।

দিলপাশার, পার-ভাঙ্গুড়া ও সদর ইউনিয়ন: এখানে কাবিটা ও টিআর প্রকল্প মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকার প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কিছু প্রকল্পে কাজ শুরুর প্রমাণ ও নেই, কোথাও আছে শুধু মাটি ফেলানো বা সামান্য মেরামত।

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা হলে আব্দুল লতিফ জানান, রাস্তায় এক টুকরো মাটিও পড়ে নাই, শাহ আলম ও ওসমান প্রামানিক জানান, বাঁশের সাঁকো বানানোর কোনো নামগন্ধ নাই। এছাড়াও মহির উদ্দিন, মঈান উদ্দিন, তাইজাল শেখসহ অনেকেই জানিয়েছেন, অনেক প্রকল্পে কাজ হয়নি, অথচ বিল তোলা হয়েছে।

এ দিকে খানমরিচ ইউনিয়নের মুন্ডুমালা প্রকল্পের পিআইসি ও ইউপি সদস্য গোলাম কিবরিয়া বলেন, প্রকল্প বিষয়ে আমি কিছু জানিনা তবে চেয়ারম্যান পিআইসিতে আমার নাম দিয়েছে।
মুন্ডমালা প্রকল্প পিআইসি ও ইউপি সদস্য আবু সাঈদ বলেন, মুন্ডুমালা কোন কাজ আমি করিনি।

এ বিষয়ে খান মরিচ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন খান মিঠু বলেন, কিছু কাজ বর্ষার পূর্বে এই অর্থ বছরেই অগ্রিম করে রেখেছিলাম এ বছরে প্রকল্প দিয়েছি। কিছু প্রকল্পের কাজ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সকল কাজই হয়েছে আপনাদের চোখে পরে নাই।

অষ্টমনিষা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন, বিল তুলেই পরে কাজ করা হয়। আপনি আসেন, মুখোমুখি কথা বলি।

এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফেরদৌস হোসেন বলেন, পূর্বের কাজে যদি কোন অর্থ বরাদ্দ না থাকে তবে অর্থ বছরে সমন্বয় করা যেতে পারে, পূর্বে এমপি সাহেবের কাজে শুধুমাত্র শ্রমিকের বিল দেওয়ার জন্য এখানকার নেতাদের সুপারিশে প্রকল্প দেওয়া হয়েছে।

এসব প্রকল্পের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. নাজমুন নাহার বলেন, টিআর, কাবিটা প্রকল্পে কাজের শুরুতেই অর্ধেক বিল প্রদানের সুযোগ আছে। এখন পর্যন্ত কোনো প্রকল্পের সম্পূর্ণ বিল ছাড় করা হয়নি। মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। তিনটি প্রকল্পের কাজ ফসল থাকায় শুরু করা সম্ভব হয়নি, সামনে ফসল উঠলে কাজ করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত চুড়ান্ত বিল ছাড় করা হবে না। এস্টিমেট অনুযায়ী কাজ সমাপ্ত হলেই চুড়ান্ত বিল ছাড় করা হবে। কাজ না করে সম্পূর্ণ বিল উত্তলন করার কোনো সুযোগ নেই। উর্ধতন কর্তৃপক্ষ চাইলে তদন্ত করে দেখতে পারেন। প্রতিটি প্রকল্পে শতভাগ কাজ বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

সুশীল সমাজ ও এলাকাবাসী বলছেন, এসব অনিয়ম পূর্বপরিকল্পিত। স্বচ্ছ তদন্ত না হলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের দুর্নীতি চলতেই থাকবে। প্রকল্পের টাকা যদি মাঠে কাজে না লাগে, তাহলে এমন প্রকল্পের মানে কী? কাবিটা ও টিআর প্রকল্পে অনিয়মের মাত্রা এতটাই প্রকট যে, এটি একটি বৃহৎ দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে এই দুর্নীতি স্থানীয় প্রশাসনের ওপর আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, উচ্চমহল থেকে আদৌ তদন্ত হয় কিনা, না কি আবারও “ফাইল চাপা” হয়ে যায়।