ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর ১১ দিন পার হয়েছে। সংঘাত বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রবল প্রতিরোধের কারণে রাশিয়া অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ইউক্রেন দখল করে নিতে পারেনি। ইউক্রেন কোনো বাহ্যিক শক্তির সহায়তা না পেলেও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে আছে রাশিয়া। রাজধানী কিয়েভসহ প্রধান শহরগুলো রুশ বাহিনীর নিশানার মধ্যে রয়েছে। ইউক্রেন বাহনীকে দুর্বল করতে না পেরে আক্রমণের মাত্রা ক্রমেই বাড়াচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন কীভাবে কারো সহায়তা ছাড়াই ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর একটানা হামলার মুখেও কীভাবে টিকে আছে সেটি বিশ্ববাসীর কাছেই এক বড় প্রশ্ন।
সমর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জামাদি দিয়ে যুদ্ধ জেতা যায় না। এমনকি সামরিক বাহিনীর আকৃতিও প্রধান বিবেচ্য নয়। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মনস্তত্ত্ব যুদ্ধের অন্যতম নিয়ামক। প্রথমত কীসের জন্য এই যুদ্ধ, সেটা সৈন্যদের কাছে স্পষ্ট হতে হবে। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কমান্ডার বা সরকারের ওপর সৈন্যদের আস্হা আছে কি না সেটাও একটি দেখার বিষয়। তাছাড়া নিজ দেশের জনগণের সমর্থন থাকা বা না থাকাও তাদের মনস্তত্ত্বের ওপর প্রভাব ফেলে। যেমন, খেলার মাঠে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া খেলোয়াড়দের প্রভাবিত করে। যুদ্ধ কি আসলেই অনিবার্য ছিল, সংঘাত এড়ানোর কি কোনো উপায় ছিল প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর থাকা প্রয়োজন। যুদ্ধের একটি বাস্তব যৌক্তিকতা থাকতে হবে।
ইউক্রেনের দিক থেকে দেখলে তারা দেশের জন্য লড়ছে, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। সেনাবাহিনী তার দেশের জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছে। বহু প্রবাসী দেশে ফিরে এসে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে রুশ সৈন্যদের প্রশ্ন করছে কেন তারা এসেছে, তারা তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলছে। মেলিটোপোল এলাকায় লোকজন তাদের ‘ফ্যাসিস্ট’ এবং ‘দখলদার’ বলে স্লোগান দিচ্ছে। রুশ সৈন্যরা বাধ্য হয়ে জনতার দিকে তাক না করে শূন্যে গুলি ছুড়ছে।
অন্যদিকে রুশ শিবিরে চিত্রটি ভিন্ন। তারা বুঝতে পারছে না তারা আসলে কীসের জন্য লড়াই করছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের মুখোমুখি হওয়ার সময় তারা বিব্রত হচ্ছে। কত দিন যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে হবে সেটাও বলা যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলো তাদের মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
রুশ মিডিয়া ও দেশটির কর্মকর্তারা বলার চেষ্টা করছে, এই পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। জনগণকে তারা মানবঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনকে নাত্সি মুক্ত করাই প্রধান লক্ষ্য বলে রুশ গণমাধ্যম দাবি করেছে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেনস্কি ব্যক্তিগতভাবে একজন ইহুদি। তা সত্ত্বেও মস্কো তার সরকারের বিরুদ্ধে নাত্সিবাদের অভিযোগ এনেছে। রাশিয়া এখন ‘আন্তর্জাতিক অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট কংগ্রেস’ আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু জানিয়েছেন, নব্য নাত্সিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত গড়ে তোলাই এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করতে রুশ বর্ণনাগুলো ঠিক হালে পানি পাচ্ছে না।
স্যাটেলাইট ছবিতে ধরা পড়েছে রুশ হামলার চিত্র
বিষয়টি এমন যেন সোভিয়েত সেনারা লড়ছে নাত্সিদের সঙ্গে। রাশিয়া যেন সেই পুরোনো স্মৃতি নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমই এখন রুশদের খবরের উত্স। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অকুস্হলের খবর জানতে পারছে না। কারণ পুতিনের নির্দেশে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সৈন্যদের ব্যাপারটা অন্য রকম। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্হা জানার সুযোগ পাচ্ছে। ইউক্রেনের বড় শহরের বিলবোর্ডে সৈন্যদের উদ্দেশে দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান শোভা পাচ্ছে। বিলবোর্ডের লেখাগুলো বেশ মানবিকধর্মী। যেমন, ‘মানুষ মেরে হাত রঞ্জিত না করে, মানুষ হিসেবে দেশে ফিরে যাও’। এগুলো সরকারের বা কোনো মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি নয়। একেবারে আমজনতার মনের কথা। যা রুশ সৈন্যদের মনোবলের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
রাশিয়া হয়তো ধারণা করেছিল ২০১৪ সালে তাদের ক্রিমিয়া দখল যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিয়েছিল। এবারও বাইরের দুনিয়ার প্রতিক্রিয়া সেরকম হবে। কিন্তু এবার প্রতিক্রিয়া হয়েছে অনেক তীব্র। চারটি রুশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর জের রাশিয়াকে অনেক দিন ধরে টানতে হবে। তাই একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় মনস্তাত্ত্বিকভাবে ইউক্রেনই এগিয়ে রয়েছে এই যুদ্ধে। পুতিন ও তার রাশিয়া কুড়িয়ে চলেছে বিশ্ববাসীর নিন্দা ও অসমর্থন, অন্যদিকে জেলেনস্কি ও তার ইউক্রেন কুড়িয়ে চলেছে কোটি কোটি মানুষের সমর্থন ও সমবেদনা।