২০শে জুলাই, ২০২৫ 🔻 ৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২🔻 ২৪শে মহর্‌রম, ১৪৪৭

সিরাজের নিউক্লিয়াস— মনসুর আলম খোকন

শেয়ার করুন:

১৯৬২ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একদল সচেতন যুবক ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল-স্বাধীনতার পক্ষে কর্মী সৃষ্টির পাশাপাশি ছাত্রলীগকে গতিশীল ও  সুশৃঙ্খল সংগঠনরূপে গড়ে তোলা। এছাড়া তাদের আরও লক্ষ্য ছিল-স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে থেকেই একটি আত্মসচেতন কেন্দ্র হিসেবে পিকিং ও মস্কোপন্থী ধারার পাশপাশি তৃতীয় মার্কসীয় ধারা হিসেবে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণিকে একত্র করার পাশাপাশি এদেশে সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়া। মূলত এ উদ্দশ্যগুলোকে সামনে রেখেই ১৯৬২ সালে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন বলে দাবি করা হয়।
আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী দল আর শেখ মুজিব স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন বলে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে এরা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেয় ও দলের সাথে নিজেদের আত্মস্থ করে। এরা বরাবরই ছিল দলের ভেতর একটি সুস্পষ্ট, সচেতন ও স্বাধীন নিউক্লিয়াস। এটি ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’, ও ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী কেন্দ্র’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকে।
প্রথমে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ এই তিনজন এ গোপন সংগঠন সৃষ্টি করেন। আবুল কালাম আজাদ (পরে অধ্যাপক ও প্রাথমিক শিক্ষক নেতা) ও চট্টগ্রামের এমএ মান্নান যথাক্রমে ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত হন। তবে তারা শেষাবধি সক্রিয় ছিলেন না। আরও বলা হয়, ১৯৭০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিউক্লিয়াস ও এর রাজনৈতিক শাখা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এর কর্মপদ্ধতি, সাংগঠনিক বিস্তৃতি ও বিস্তারিত কার্যাবলি সম্পর্কে অবহিত করার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন হন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিবের সুপারিশে শেখ ফজলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদকে বিএলএফ’র হাইকমান্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৬৮,৬৯,৭০ সালে মহকুমা (বর্তমানে জেলা) পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের শাখা বিস্তৃত হয়। প্রতিটি মহকুমায় ৪-৫ জন সদস্য সংগৃহিত হয়। এর সদস্য মূলতঃ ছাত্রলীগ থেকে এবং সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী বাইরে থেকে সংগৃহিত হতো। দাবি করা হয়, ‘১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সবকটি আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন সবকিছুরই মূলে ছিল নিউক্লিয়াস।
নিউক্লিয়াসের শাব্দিক অর্থ মূলধারা অর্থাৎ যাকে ঘিরে অন্যান্য অংশ বিন্যস্ত/সংহত হয়। পাকিস্তানে অবাঙালি অধ্যুষিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে নিউক্লিয়াস সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিকল্প সমাজ শক্তি হিসেবে ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক ‘ব্রিগেড’ গড়ে তুলে নৈশ প্রহরা, ট্রাফিক-ব্যবস্থা, মেইল-ট্রেন চালু, লঞ্চ-স্টিমার-নৌ বন্দর পরিচালনা, এমসিসি-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা পরিচালনা, থানা পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, শিল্প-কল-কারখানায় শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি’ যাবতীয় কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। আরও দাবি করা হয়, ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট  ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির এক বর্ধিত সভায় স্বপন কুমার চৌধুরীর মাধ্যমে এরা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং এদের সাথে আলোচনা করেই শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণদানও অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৫ মার্চের আগেই এরা বিএলএফ গড়ে তোলে যুদ্ধকালে যা মুজিব বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পায়।
এছাড়া এরা স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, পতাকা তৈরি ও উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত প্রভৃতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এক কথায় ১৯৬৫’র পর থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কৌশল নির্ধারণ ও পরিকল্পনার নির্দেশনা নিউক্লিয়াস থেকেই আসতো। মাওলানা ভাসানী, সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন, পূর্বপাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (হক-তোয়াহা) ও ন্যাপের (ভাসানী) একাংশ এবং শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের সঙ্গে নিউক্লিয়াস যোগাযোগ রক্ষা করতো। কামরুদ্দিন আহমেদ ও ড. আহমদ শরীফ শুরু থেকেই এদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন বলেও দাবি করা হয়।  ১৯৭৪ সালের জুনে জাসদের জাতীয় কমিটির বর্ধিত সভার পর একটি ক্ষুদ্র সমন্বয় কমিটি গঠন করা হলে ‘নিউক্লিয়াস’ নিজেদেরকে বিলুপ্ত করে উক্ত সমন্বয় কমিটির সাথে একিভূত হয়।
   লেখক:
 শিক্ষক ও সাংবাদিক