২২শে জুন, ২০২৫ 🔻 ৮ই আষাঢ়, ১৪৩২🔻 ২৫শে জিলহজ, ১৪৪৬

স্কাইপ বন্ধ: একটি যুগের অবসান

শেয়ার করুন:

দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিশ্বজুড়ে ব্যক্তিগত ও পেশাগত যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে পরিচিত স্কাইপ (Skype) আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে—এই ঘোষণাটি প্রযুক্তি দুনিয়ায় একপ্রকার যুগের অবসান হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে যে, ২০২৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যে স্কাইপের সকল সার্ভিস ধাপে ধাপে বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং এটি আর ব্যবহারযোগ্য থাকবে না।

২০০৩ সালে লুক্সেমবার্গে প্রতিষ্ঠিত স্কাইপ প্রথম বাজারে আসে ফ্রি ভয়েস ও ভিডিও কলের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। এটি দ্রুতই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করে, বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সার, প্রবাসী এবং ছোট ব্যবসার মধ্যে। ২০১১ সালে মাইক্রোসফট প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে স্কাইপ অধিগ্রহণ করে। অধিগ্রহণের পর, স্কাইপ উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে এবং অফিসিয়াল কমিউনিকেশন টুল হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়।

স্কাইপের মাধ্যমে শুধুমাত্র কল ও ভিডিও কনফারেন্সই নয়, বরং ফাইল শেয়ার, চ্যাট, এবং ইন্টারন্যাশনাল ফোন কলের সুবিধাও পাওয়া যেত। এটি বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের জন্যও একটি নির্ভরযোগ্য সমাধান হিসেবে বিবেচিত ছিল।

মাইক্রোসফট স্কাইপ বন্ধের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে পরিবর্তিত ব্যবহারকারীর চাহিদা ও টেকনোলজির অগ্রগতিকে। ২০২০ সালের পর থেকে টিমস (Microsoft Teams) এবং জুম (Zoom)-এর মতো আধুনিক ভিডিও কনফারেন্সিং টুলগুলোর জনপ্রিয়তা স্কাইপকে অনেকটা ছায়ায় ফেলে দেয়। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময়, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টিমস এবং গুগল মিটের মতো টুলগুলোর উপর নির্ভর করতে শুরু করে।

স্কাইপ টেকনোলজিক্যালি অনেক পুরোনো কাঠামোর উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়ায় নতুন ফিচার যুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। মাইক্রোসফট তাই তাদের রিসোর্স ও ডেভেলপমেন্ট টিমকে Teams-এর দিকে স্থানান্তর করে স্কাইপকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

যারা এখনও স্কাইপ ব্যবহার করছেন, তাদের জন্য মাইক্রোসফট বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে Microsoft Teams ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। Teams-এ অনেকাংশেই স্কাইপের ফিচারগুলো বিদ্যমান, বরং আরও উন্নত ফিচার যেমন টাস্ক ম্যানেজমেন্ট, ফাইল স্টোরেজ এবং ইন্টিগ্রেটেড অ্যাপ সাপোর্ট প্রদান করে।

ব্যবহারকারীদের স্কাইপে সংরক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ চ্যাট হিস্টরি, ফাইল এবং কনটাক্টগুলো দ্রুত ব্যাকআপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাইক্রোসফট একটি ডেটা এক্সপোর্ট টুলও চালু করেছে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের সমস্ত ডেটা নিরাপদে সংরক্ষণ করতে পারবেন।

স্কাইপ বন্ধের খবরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেক পুরোনো ব্যবহারকারী নস্টালজিক অনুভব করছেন। তাদের মতে, স্কাইপ কেবল একটি অ্যাপ ছিল না—বরং এটি ছিল দীর্ঘদিনের যোগাযোগের স্মৃতির সাথী। আবার অনেকেই মনে করছেন, সময়ের দাবি পূরণে এই পরিবর্তন প্রয়োজনীয় ছিল।

একজন পুরোনো ব্যবহারকারী বলেন, “স্কাইপের মাধ্যমে আমি জীবনে প্রথম ভিডিও কল করেছিলাম। এখন সেটি হারিয়ে যাওয়ার মতোই অনুভব হচ্ছে।”

অন্যদিকে প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, “স্কাইপের শেষ কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছে মাইক্রোসফট নিজেই, যখন তারা Teams-কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এটি সময়ের স্বাভাবিক পরিবর্তন, তবে স্কাইপ প্রযুক্তি ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকবে।”

স্কাইপের বিদায় প্রযুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। যদিও এটি এখনকার প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অপরিচিত একটি নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবুও অতীতের ডিজিটাল বিপ্লবের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে স্কাইপ তার স্থান চিরকাল অমলিন রাখবে।

স্কাইপ চলে গেলেও স্মৃতি থাকবে—প্রথম ভিডিও কল, দূর দেশে প্রিয়জনের সাথে রাত জেগে কথা বলা, কিংবা ব্যবসায়িক মিটিং। এই সফটওয়্যারটি শুধুই একটি অ্যাপ নয়, বরং একটি ডিজিটাল যুগের প্রতীক।