ইছামতিনিউজ২৪. কম রিপোর্টঃ মুক্তিযোদ্ধার লাল মুক্তিবার্তার নম্বর জালিয়াতি করে হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা বনে গিয়েছিলেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু, যিনি বর্তমানে বগুড়ার শেরপুর উপজেলা পরিষদেরও চেয়ারম্যান। জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়লে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে মজনুর নাম বাদ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
শুধু বগুড়ার মজনু নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছলে-বলে ঢুকে পড়েছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাতার নিচে। আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে এবং পৌরসভা কমিটিতে ঢুকে পড়েছেন রাজাকারসহ অনেক বিতর্কিতরা। এসব হাইব্রিড, বিতর্কিত এবং রাজাকার ও তাদের পোষ্যদের দাপটে কোথাও কোথাও দলের প্রকৃত নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
অভিযোগে জানা গেছে, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান মজনু মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠাতে ব্যক্তিগত তথ্যে লাল মুক্তিবার্তার যে ‘১২১’ নম্বরটি ব্যবহার করেছেন, সেটি আদমদীঘি উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমানের। নামে মিল থাকায় সুযোগ নিয়ে জালিয়াতি করেন মজনু, ২০০৫ সালে এক গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম অন্তভুর্ক্ত করাতেও সক্ষম হন তিনি। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান অভিযোগ করলে দীর্ঘ ১৬ বছর পর মজনুর জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে শুনানি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। শুনানিতে স্থানীয় তিনজন মুক্তিযোদ্ধা সাক্ষ্য দেন। তবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে মজনু কোনো দলিলপত্র দেখাতে পারেননি। পরে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৭৮তম সভায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে মজনুর নাম বাদ দেওয়া হয়।
এতকিছুর পরেও ঘটনাটি তেমন জানাজানি হয়নি। মাস ছয়েক আগে বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা মজনুর মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের বিষয়টি ফেসবুক লাইভে প্রকাশ করলে স্থানীয়রা বিষয়টি জানতে পারেন। জানা গেছে, মজনুর শ্বশুর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। অভিযোগের বিষয়ে মজনু বলেছেন, গেজেট বাতিলের বিষয়টি তিনি শুনেছেন, এ ব্যাপারে তিনি আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছেন। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রেজাউল করিম মন্টু সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মজনুর ঘটনাটি জেলা আওয়ামী লীগের জন্য লজ্জার’।
শান্তি কমিটির মেয়ের জামাই বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও শেরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মজনু। অন্যদিকে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন কালুর বাবা হাজি আকবর আলী ছিলেন শান্তি কমিটির সদস্য। কালু একসময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে দলটির উপজেলার আহ্বায়ক কমিটি থাকায় তিনি সদস্য। কালু দুইবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, ছিলেন পৌরসভার মেয়র। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রশ্ন তুললে গত ১১ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে শামসুদ্দিন কালু বলেছেন, ‘বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও ফেসবুকে প্রায়ই একটি কথা আসে—আমার বাবা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। আমার প্রশ্ন রাজাকারটা কি? এটা আগে জানতে হবে। রাজাকার আর শান্তি কমিটির সদস্য এক জিনিস নয়। আমি রাজাকারের ছেলে নই। আমি ছাত্রলীগ করেছি।’
ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জ মডেল থানার বর্তমান প্রেক্ষাপটও প্রায় অভিন্ন। সেখানকার সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্যাহ আমানের সক্রিয় অনুসারী ছিলেন প্রয়াত মধু মাঝি। তার ছেলে হাবিবুর রহমান হাবিব অর্থের বিনিময়ে বাগিয়েছেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদকের পদ। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ‘নৌকা’প্রতীকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন শাক্তা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছেন।
কিছুদিন আগে হওয়া কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হতে জোরালোভাবে মাঠে নেমেছিলেন হাবিবুর রহমান হাবিব। এ নিয়ে দলের ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ জানালে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘দলের প্রকৃত নেতাকর্মীদের চাওয়ার বিপরীতে যাওয়ার সুযোগ নেই, কোনো ভূমিদস্যু ও হাইব্রিডকে দলের পদে ঠাঁই দেওয়া হবে না।’ শেষ পর্যন্ত আর সাধারণ সম্পাদক হতে পারেননি হাবিব। তবে দমেননি তিনি। মডেল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউসুফ আলী চৌধুরী সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বিপ্লবসহ দলের উপজেলা কমিটিকে অর্থের বিনিময়ে করায়ত্ব করেছেন হাবিব। ‘কমিটি আমার পকেটে, আমি যা বলব তাই হবে’—প্রকাশ্যে এমন কথা বলে এলাকায় একচেটিয়া প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে তুলেছেন তিনি। সহোদর ছলিমউল্যাহকে নিয়ে হাবিব কেরানীগঞ্জে গড়ে তুলেছেন ‘মধুসিটি’নামের আবাসন প্রকল্প। স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের কমিটিকে ম্যানেজ করে বুড়িগঙ্গার শাখা নদী, খাল, সরকারি খাস জমি এবং স্থানীয়দের পৈত্রিক বসতভিটা ও কৃষিজমি বেদখলের অভিযোগ রয়েছে এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে।
এদিকে, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর আলগী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর তালিকায় বিএনপির পদধারী ২৭ নেতাকে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মনির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী এই তালিকা করেন। এ নিয়ে গত ১৪ এপ্রিল ঐ ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মো. আবদুর রব দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ করেছেন।
এর আগে এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সহসভাপতি মনিরুল ইসলাম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে তালিকায় অসঙ্গতি ও অনিয়মের সত্যতা পাওয়া যায়। ১ মার্চ তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একটি ওয়ার্ডে সম্মেলন ও দুটি ওয়ার্ডে সভা করে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। ইউনিয়নের অন্য ছয় ওয়ার্ডে কোনো কমিটি করা হয়নি, কিন্তু ঐ ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনগড়া ৯টি ওয়ার্ডের কমিটি করে উপজেলায় জমা দিয়েছেন।
জানা গেছে, ঐ ইউনিয়নে সম্মেলনের জন্য ২৫১ জনকে কাউন্সিলর করা হয়। এর মধ্যে ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি মজিবুর রহমানকে একই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি দেখিয়ে কাউন্সিলর করা হয়। ১ নম্বর ওয়ার্ডে আনোয়ার হোসেন, আব্দুল কুদ্দুস, আবদুল হাসিমকে কাউন্সিলর করা হয়েছে। তারা সবাই ঐ ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য। ২ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সহসভাপতি জয়নাল আবেদিন ও আবুল কাশেমকে কাউন্সিলর করা হয়। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে মো. সেলিমকে কাউন্সিলর করা হয়েছে। তিনি ঐ ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য।
৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সিরাজকেও কাউন্সিলর করা হয়। এছাড়া ৪ নম্বর ওয়ার্ডে আবদুর রব, আবুল কাশেম, মো. দিদার, বেলাল উদ্দিন; ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মো. জামাল, আবদুজ জাহের, মো. মোস্তফা; ৬ নম্বর ওয়ার্ডে মো. কামাল, মো. সিরাজ; ৭ নম্বর ওয়ার্ডে মহিউদ্দিন হেজু, জাহের উদ্দিন, মো. নিজাম (আবদুল মুন্সি), সাইফ উদ্দিন; ৯ নম্বর ওয়ার্ডে শেখ ফরিদ ও মো. লিটনকে কাউন্সিলর করা হয়। তারা প্রত্যেকেই ওয়ার্ড বিএনপির দায়িত্বশীল নেতা।