ইছামতিনিউজ২৪.কম রিপোর্টঃ আজ সেই ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে চালায় বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। যেটি ছিল বাঙালির একটি প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার এক নারকীয় পরিকল্পনা। এইরাতে চেষ্টা করা হয়েছিল ঘুমন্ত অবস্হায় বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলার।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে জেনারেল টিক্কা খান বলেছিলেন, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের মাটি চাই, মানুষ চাই না’। ফলে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত। ২৫ মার্চ পাক-হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দানবের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সর্বস্তরের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিশ্বের অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও দেশের মধ্যে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো হয়। এছাড়া পাঁচটি উপাদানের মধ্যে চারটি বিদ্যমান থাকলেও বাংলাদেশের ভয়াবহ এই গণহত্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বা জাতিসংঘের স্বীকৃতি এখনও পায়নি।
বিদেশিদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগও সীমিত। কারণ জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৫ সালে। আর্মেনিয়ায় গণহত্যার বিষয়ে দেশটির প্রস্তাবের ভিত্তিতে দিবসটি ঘোষণা করা হয়। ফলে জোরালো কূটনৈতিক তত্পরতা ছাড়া ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা’ আদায় করা খুব সহজ হবে বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে জাতীয় সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে চোখে পড়ার মত তেমন কোনো কূটনৈতিক তত্পরতা নেই।
দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনও না মিললেও ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই বছর সরকারি প্রজ্ঞাপনে ২৫ মার্চকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। আন্তর্জাতিকভাবেও দিবসটি পালনের জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি জানিয়ে আসছিল ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯৩ সাল থেকেই কালরাত পালনের কর্মসূচি শুরু করে নির্মূল কমিটি। কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির জানান, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তারা ২৫ মার্চের পক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরেছেন।
কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার রাষ্টÌবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অ্যাডাম জোনস বলেছেন, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হলেও তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি আজও; বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ’ হিসেবে দেখার তীব্র প্রবণতা রয়েছে।’ ২০১৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পরে, ঢাকায় এ কথাগুলো বলেছিলেন অ্যাডাম জোনস। বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি এখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত।
তবে সংজ্ঞাগত ও তাত্ত্বিকভাবেই বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন ‘দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে’ গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া- এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে।
কানাডা ও আর্জেন্টিনা ছাড়াও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত নির্মম গণহত্যার বিষয়টি ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ও গবেষণা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি ও ডিপল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরি, ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজে গণহত্যার বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের গণহত্যাকে ইয়েলের পাঠ্যসূচিতে স্হান দিতে ভূমিকা রেখেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক বেন কিয়েরনান। শাহরিয়ার কবির পরিচালিত তথ্যচিত্র ওয়ার ক্রাইম ১৯৭১-এ তিনি এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ২০ শতকের শেষদিকে বাংলাদেশের গণহত্যা ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালে এবং পূর্ব তিমুরে ১৯৭৫ সালে সংঘটিত গণহত্যার মতোই ভয়াবহ।
জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক আবেদনের আহ্বান
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বাংলাদেশের সরকারকে অবিলম্বে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন জানানোর দাবি জানিয়েছেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম—মুক্তিযুদ্ধ‘৭১ এর নেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি-জাতিসংঘের ব্যর্থতা’ শীর্ষক সেমিনারে তারা এই দাবি জানান। সংগঠনের নেতারা বলেছেন, জাতিসংঘ ১৯৭১ সালের আগের, এমনকি পরেরও বহু গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার ফলে জাতিসংঘ তার প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সেমিনারে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাষ্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, আর বিলম্ব না করে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানাতে হবে। লেখক ও সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করে জাতীয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারকে জাতিসংঘের কাছে আবেদন করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, জাতিসংঘের স্বীকৃতি আদায়ে সরকারকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যথায় এই স্বীকৃতি মিলবে না।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সংঘটিত অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে এবছর স্বীকৃতি দিয়েছে ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ এবং ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’। সংস্হা দুটি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্যও আহ্বান জানিয়েছে।








