১০ই ডিসেম্বর, ২০২৫ 🔻 ২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২🔻 ১৮ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭

কোরবানি ঈদ কেন পালন করা হয়: ত্যাগ ও আত্মনিবেদনের অনন্য শিক্ষা

শেয়ার করুন:

ইসলামের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা, যা কোরবানি ঈদ নামেও পরিচিত, মুসলিম উম্মাহর জন্য এক মহামিলনের দিন। এই উৎসব মূলত ত্যাগ, আত্মনিবেদন ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রতীক। তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—কোরবানি ঈদ কেন পালন করা হয়?

ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা ও পালন ইসলামের অন্যতম নবী হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মরণে অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হন, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রমাণের জন্য। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে জান্নাত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন, যা কোরবানি করা হয়।

এই ঘটনা থেকেই মুসলিম বিশ্বে কোরবানির প্রচলন শুরু হয়। এটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক গভীর আত্মনিবেদনের প্রতীক হয়ে ওঠে। মুসলিমরা প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পশু কোরবানি করে সেই আত্মত্যাগের মহান শিক্ষা স্মরণ করে থাকেন।

ইসলাম মতে, কোরবানি ফরজ না হলেও সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য এটি ওয়াজিব। হাদীসে এসেছে—“আল্লাহর নিকট কোরবানির পশুর রক্ত ও গোশত পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ: ৩৭)
অর্থাৎ, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, আত্মশুদ্ধি ও সমাজে সহমর্মিতা সৃষ্টি।

সামাজিক কল্যাণ ও মানবিক সহমর্মিতার অনন্য দৃষ্টান্ত

ঈদুল আজহার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে কেবল ব্যক্তি ইবাদত নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পারস্পরিক সহমর্মিতাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরবানির মাধ্যমে একজন মুসলমান তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী একটি পশু কোরবানি দেন এবং তার গোশত ভাগ করে অন্যদের সঙ্গে উপভোগ করেন।

🔹 কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করার বিধান রয়েছে।
এক ভাগ নিজের পরিবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য এবং এক ভাগ সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়। এই মাংস বিতরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে।

🔹 কোরবানির এই কর্মসূচি শুধু খাবার ভাগাভাগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি একটি নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেয়। অনেক গরিব মানুষ সারা বছর হয়তো গরুর বা খাসির মাংস খেতে পারেন না, কিন্তু ঈদুল আজহার কোরবানির কারণে তাঁরাও সেই আনন্দে সামিল হতে পারেন।

🔹 এতে করে সমাজে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হয়, সামাজিক বিভাজন হ্রাস পায় এবং ধনী-গরিবের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়।

এইভাবে ঈদুল আজহা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার বাস্তব রূপায়ণ—যার মধ্য দিয়ে মানবতা, দানশীলতা ও নৈতিকতার চর্চা হয়। এক কথায়, কোরবানির ঈদ সমাজের ভেতরে এক ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা বহন করে।

কোরবানির নিয়ম ও করণীয়
ঈদুল আজহার কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা ইসলামের অন্যতম সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দিককে তুলে ধরে। তবে এই ইবাদত সঠিকভাবে পালনের জন্য রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও শর্ত, যা প্রতিটি মুসলমানের জানা ও পালন করা জরুরি।

✅ কোরবানি করার জন্য মুসলমান, প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হওয়া আবশ্যক
শরীয়তের দৃষ্টিতে কোরবানি করা সেই ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব, যিনি মুসলমান, প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগ), সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী এবং নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক—অর্থাৎ যাঁর কাছে ঈদের দিন ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিজের প্রয়োজন ও দেনা-পাওনার অতিরিক্ত মূলধনের মালিকানা থাকে। এই শর্ত পূরণ না হলে কোরবানি করা ফরজ বা ওয়াজিব নয়।

✅ কোরবানির পশু নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে

  • গরু ও উট: কমপক্ষে ৫ বছর বয়সী হতে হবে।
  • ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা: কমপক্ষে ১ বছর বয়সী হতে হবে।

এর চেয়ে ছোট পশু শরীয়ত অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। তবে, যদি এক বছরের কম বয়সের ভেড়া বা দুম্বা দেখতে এক বছরের সমান লাগে, তবে তা কিছু ক্ষেত্রে কোরবানিযোগ্য হতে পারে (বিশেষ ফিকহি মতানুসারে)।

✅ পশু হতে হবে সুস্থ, নিরোগ ও শরীয়ত সম্মত
কোরবানির পশু অবশ্যই শারীরিকভাবে সুস্থ, সবল এবং দৃষ্টিগোচর কোনো বড় দোষ বা ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে হবে। যেমন:

  • এক চোখ অন্ধ
  • অতিরিক্ত ল্যাংড়া বা পঙ্গু
  • খুব দুর্বল ও হাড্ডিসার
  • কান বা লেজ সম্পূর্ণ কাটা

এসব ত্রুটি থাকলে পশুটি কোরবানির জন্য গ্রহণযোগ্য হবে না।

✅ কোরবানির মাংস ন্যায়সঙ্গতভাবে ভাগ করে বিতরণ করতে হবে
কোরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করা সুন্নাত:
১. এক ভাগ নিজের পরিবারের জন্য
২. এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের জন্য
৩. এক ভাগ গরিব ও অসহায়দের মাঝে বিতরণের জন্য

ঈদুল আজহার কোরবানি মুসলিম জাতির জন্য একটি পবিত্র ত্যাগের নিদর্শন, যা আমাদেরকে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ শেখায়। ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগের এই মহান ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে সর্বোচ্চ পর্যায়েও উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকা উচিত।

কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা শুধু নিজ নিজ ইমানকে মজবুত করেন না, বরং সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগও পান। মাংস বণ্টনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে সামাজিক সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সহানুভূতির অনন্য এক বন্ধন।

অতএব, আমাদের উচিত কোরবানির আধ্যাত্মিক ও সামাজিক গুরুত্বকে উপলব্ধি করে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী এই ইবাদত যথাযথভাবে পালন করা, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি মানবিক দায়িত্বও সুন্দরভাবে পালন করা যায়।