৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ 🔻 ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২🔻 ১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭

পাবনার গাজনার বিল অমৎস্যজীবীদের দখলে, প্রকৃত মৎসজীবীদের মানবেতর জীবন যাপন

শেয়ার করুন:

কাজী বাবলা,পাবনা:

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল পাবনার গাজনার বিল। যুগ যুগ ধরে প্রকৃত জেলেরা এ বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও বর্তমানে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। সরকারি বিধি অমান্য করে ১৫ কিলোমিটার দূরের কতিপয় প্রভাবশালী অমৎস্যজীবীরা নানা কৌশলে বিশাল এ বিল (জলমহাল) লিজ নিয়ে মাছ শিকার করছে। চলতি মৌসুমে এ বিলে সরকারি আইন অমান্য করে সাব লিজ দেয়া নিয়ে বিলপাড়ে সংর্ঘষও হয়েছে।  অন্যদিকে প্রকৃত মৎস্যজীবিরা জলমহাল হারিয়ে অর্ধহারে অনাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে।  
সরজমিন ঘুরে জানা গেছে, পাবনার সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল মৌজাটি রানীনগর ইউনিয়নের অধীন। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এ মৌজার জলমহালটি রানীনগর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির আওতাধীন ১৫০জন জেলে সদস্য লিজ নিয়ে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে। ২০০৩ সালে এ সমবায় সমিতি অকার্যকর হয়। এরপর ২০০৫ সালে ভুমি মন্ত্রণালয় থেকে মৎস্য মন্ত্রণালয়ে এ জলমহাল হস্তান্তর করা হয়। এরপর মৎস অধিদফতর অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে বিলুপ্তপ্রায় মৎস্য পুনরুদ্ধার প্রকল্প হাতে নেয়। সে সময় বিলপাড়ের প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিয়ে স্থানীয় জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সাথে মৎস্য বিভাগের চুক্তিও সাক্ষরিত হয়। এ কমিটি  ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্প বাস্তবায়ণ করে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উক্ত কমিটি সরকারি নেয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান মেনে টাকা জমা দিয়ে জলাশয় ভোগ দখল করে। এসময় বিলে পুকুর খননসহ বিলুপ্ত কয়েক প্রজাতির মাছ পুনরুদ্ধার করা হয়। জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে জলমহাল লিজের মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু মৎস্য মন্ত্রণালয় থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে এ জলমহালটি ফেরত নেয়া হয়।
ইতোমধ্যে ১৫ কিলোমিটার দূরবর্তী মানিকহাট ইউনিয়নের কতিপয় প্রভাবশালী অমৎসজীবীরা ‘বোনখোলা মৎস্যজীবী সমিতি’ নামে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে অতি গোপনে ৫ বছরের জন্য বিলের জলমহাল লিজ নেয়। এসময় জেলা প্রশাসন থেকে ভোগদখলকৃত প্রকৃত মৎস্যজীবীদের এ নিয়ে কোন নোটিশ পর্যন্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি বিধানে বিলের আওতাধীন ইউনিয়নের প্রকৃত মৎসজীবীদের লিজ দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। প্রকৃত মৎস্যজীবীরা এ লিজ বাতিলের দাবিতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন চায় ভূমি মন্ত্রণালয়। তৎকালিন জেলা প্রশাসক মো: জসিম উদ্দিন ২ আগস্ট ২০১৮ তারিখে সাব লিজ বাতিল করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের কাছে লিজ দেয়ার সুপারিশ করেন। যার স¥ারক নং ০৫.৪৩.৭৬০০.০২৮.৪০.০৬৫.১৮-১৭৩৭।
লিজ গ্রহিতা বোনখোলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি জুলফিকার খাঁ যুগ্ম জেলা জজ ২ আদালতে মামলা করেন। পরবর্তীতে এ মামলাটি কোর্ট খারিজ করলেও এখন পর্যন্ত অমৎস্যজীবীদের লিজ বাতিল করা হয়নি। জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির মৎস্যজীবীরা ২০১৯ সালের ১০ জুন রানীনগর ইউনিয়নের প্রকৃত জেলেদের নিয়ে বাদাই মৎসজীবী সমবায় সমিতি লিঃ গঠন করে। এ সমিতি লিজ বাতিল করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের লীজ দেয়ার আবেদন করেছে বলে সমিতির সভাপতি বৈদ্যনাথ হলদার জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, অবিলম্বে অমৎস্যজীবীদের এ লিজ বাতিল করতে হবে। অন্যথায় দাবি আদায়ে বিলপাড়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
এ দিকে চলতি মৌসুমে এ বিল সাব লিজ দিয়ে বিলপাড়ের আইন শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি করা হয়েছে। একই জায়গা ২ জনকে সাব লিজ দেয়ায় গত ৬ সেপ্টেম্বর বিল দখল নিয়ে বিলপারের রানীনগরে দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সাব লিজধারীদের অত্যাচারে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা বিলে মাছ শিকার করতে পারছে না বলে ১০০ মৎস্যজীবী জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপুল টাকার বিনিময়ে সাবলিজের ব্যবস্থা করায় এ বন্দুকযুেদ্ধর ঘটনা ঘটে। বিল এলাকায় সাবলিজকারীদের দাপটে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে এলাকার সাধারণ মানুষ জানিয়েছে। এদিকে প্রকৃত মৎস্যজীবী জেলেরা জলমহাল হারিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বাদাই গ্রামের মৎসজীবী পরেশ হলদার, শঙ্কর হলদার, দিলীপ হলদার, চরণ হলদার জানান, আমাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অমৎস্যজীবীরা মাছ ধরছে আর আমরা অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। বাঘুলপুর গ্রামের মৎস্যজীবী শ্রীপদ হলদার, ঠাকুর হলদার, গোবিন্দ হলদার, রঞ্জিত হলদার, প্রেম হলদার আক্ষেপ করে জানান, মাছ ধরাই আমাদের বাপ দাদার পেশা অন্য কিছুতো শিখিনি আমরা কি করে খাবো? বিল হারিয়ে ৩ বছর ধরে আমরা মানবেতর জীবন কাটালেও কোন প্রতিকার পাচ্ছি না বলেও তারা আক্ষেপ করেন। এ জেলেরা অমৎস্যজীবীদের লিজ বাতিল করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের কাছে জলমহাল ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এ ব্যাপারে পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহম্মেদ ফিরোজ কবির জানিয়েছেন, সরকারি নিয়মে রানীনগর ইউনিয়নের প্রকৃত মৎস্যজীবীরা এ জলমহাল লিজ পাওয়ার অধিকারি হলেও এখানে তার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। তিনি প্রকৃত মৎসজীবীদের মধ্যে জলমহাল ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ^াস দিয়েছেন।