১১ই ডিসেম্বর, ২০২৫ 🔻 ২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২🔻 ১৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭

মৃত্যুঞ্জয় মুজিব

শেয়ার করুন:

 আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: জীবনের একটি গর্ব, আমি এ যুগের এক বাঙালি ভলতেয়ার এবং এ যুগের এক বাঙালি আব্রাহাম লিঙ্কনকে দেখেছি। এরা হলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং অন্য জন হলেন বিশ শতকের ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুজনেই আজ প্রয়াত; কিন্তু তাদের জাগ্রত স্মৃতিস্তম্ভ রয়ে গেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও মানিক মিয়া। দুজনে দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন ও সম্মান করতেন। বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণার পর মানিক মিয়া ইত্তেফাকে তার রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে এই ছয় দফাকে যেদিন সমর্থন দিয়েছেন, সেদিন বঙ্গবন্ধুকে আনন্দে উদ্ভাসিত হতে দেখেছি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষায় বলেছেন, ‘যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নেই’।

মানিক মিয়া আকস্মিকভাবে মারা গেলে আজিমপুর গোরস্থানে তার মরদেহ সমাধিতে শোয়ানোর পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার শ্রেষ্ঠ সহযোদ্ধা এবং অভিভাবককে কবরে শুইয়ে এলাম।’ আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিক মিয়ার মৃতদেহ কবরে শোয়ানোর জন্য আজিমপুরের কবরে নেমেছিলাম। কবর থেকে উঠে এসে যখন কাপড়ের ধুলা ঝাড়ছি, তখন বঙ্গবন্ধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, আমাকে বুদ্ধি ও সাহস জোগানোর মানুষটি চলে গেলেন। আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছিলাম, বাংলার সাড়ে সাত কোটি (তখনকার জনসংখ্যা) মানুষ আপনার সঙ্গে আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।মানিক মিয়া আকস্মিকভাবে মারা গেলে আজিমপুর গোরস্থানে তার মরদেহ সমাধিতে শোয়ানোর পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার শ্রেষ্ঠ সহযোদ্ধা এবং অভিভাবককে কবরে শুইয়ে এলাম।’ আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মানিক মিয়ার মৃতদেহ কবরে শোয়ানোর জন্য আজিমপুরের কবরে নেমেছিলাম। কবর থেকে উঠে এসে যখন কাপড়ের ধুলা ঝাড়ছি, তখন বঙ্গবন্ধু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, আমাকে বুদ্ধি ও সাহস জোগানোর মানুষটি চলে গেলেন। আমি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছিলাম, বাংলার সাড়ে সাত কোটি (তখনকার জনসংখ্যা) মানুষ আপনার সঙ্গে আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর আমি একবার ওয়াশিংটনে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতাদানের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। বক্তৃতা দিচ্ছি। হঠাত্ এক বিদেশি ছাত্র আমাকে প্রশ্ন করে বসল, শেখ মুজিবকে কোনো ওয়েস্টার্ন নেতার সঙ্গে তুলনা করতে পারো, যাতে তাকে আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারি? প্রশ্ন শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেছি। হঠাত্ কী বলব? কোন পশ্চিমা নেতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে পাব? তার সমতুল্য নেতা বর্তমান পশ্চিমা দুনিয়ায় কোথায়? হঠাত্ চোখ পড়ল যে হলে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম তার দেওয়ালে। দেখি সেখানে জর্জ ওয়াশিংটন এবং আব্রাহাম লিংকনের ছবি টানানো। অকূলে কূল পেলাম।
বললাম, দেওয়ালে টানানো তোমাদের দুই প্রেসিডেন্টের ছবি। একজন দেশটার লিবারেটর, অন্যজন সেভিয়ার। বাংলাদেশ শেখ মুজিবের মধ্যে এই দুই নেতাকেই পেয়েছে। মুজিবই আমাদের লিবারেটর এবং মুজিবই আমাদের সেভিয়ার। দেখলাম প্রশ্নকর্তা ছাত্রটি খুশি হয়েছেন।

অনেকে বলেন গান্ধী দর্শন এবং শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে মিল। তিনিও গান্ধীর কাছ থেকে অহিংস আন্দোলন ধার করেছিলেন। কথাটা আংশিক সত্য। গান্ধীর কাছে অহিংস অসহযোগ ছিল রাজনৈতিক আদর্শ। বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিল রাজনৈতিক কৌশল। গান্ধী লবণ কর আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ তাতে রক্তপাত হয়েছিল। তার অহিংসার আদর্শ ক্ষুণ্ন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন; কিন্তু গোড়ায় অহিংস আন্দোলনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে স্পষ্টই বলেছেন, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। বলা বাহুল্য, এটা স্বাধীনতার জন্য গেরিলা যুদ্ধের ডাক।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে একটি জাতীয় বিপ্লব ঘটানো বিশ্ব ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেল থেকে বের হয়ে এসে স্বাধীন বাংলায় ক্ষমতা গ্রহণের পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একমাত্র চীন ও সৌদি আরব ছাড়া সারা বিশ্বের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অর্জন করেন। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণ দেন। তিনি এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন।

বঙ্গবন্ধুর সবচাইতে বড় অবদান শুধু বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনা নয়, বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি ও সভ্যতার পুনরুজ্জীবন ঘটানো। ধর্মের ভিত্তিতে বাঙালিদের মধ্যে যে বিভাজন করা হয়েছিল তিনি তা ঘুচিয়ে বাঙালির একক জাতিত্বের, একক পরিচয়ের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
তিনি গতানুগতিক রাজনীতি করেননি। জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন একটি রাজনৈতিক দর্শন। তাহলো শোষিতের গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের ভিত্তিতে তিনি এক শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। এই রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার পথে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলেন। এই সময় ঘাতকের বুলেট তাকে হত্যা করে। তাতে তার আরব্ধ কাজ কিছুটা পিছিয়ে গেছে; কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। গত বছর তার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দেখা গেছে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিবের পুনরুত্থান বাংলার ঘরে ঘরে।
সন্দেহ নেই বাংলাদেশের এক নতুন প্রজন্ম সব বাধাবিঘ্ন, ভুলভ্রান্তি, পদস্খলনের অন্ধ গলি থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ ও দেশ গঠনের কাজে আবার এগিয়ে আসতে চাইছে। তাদের পদধ্বনি এখনো হয়তো স্পষ্ট নয়; কিন্তু তা যে শিগিগরই স্পষ্ট হবে তার আভাস পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর আজ মৃত্যু দিবস। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ তার কণ্ঠ বাজছে। দেশ করোনা-আক্রান্ত। শয়ে শয়ে লোক মরছে রোজ। মৃত্যুদানবের এই থাবার মধ্যেও বাজছে বঙ্গবন্ধুর অভয়বাণী। সেই অভয়বাণীতে দীপ্ত বাংলার মানুষ। তারা এবারেও মৃত্যুদানবকে অবশ্যই পরাভূত করবে।
তিনি বাঙালি জাতির পিতা। স্বাধীন বাংলার স্থপতি। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি সাজাতে চেয়েছিলেন। পুঁজিবাদের চক্রান্ত ও আঘাতে তার স্বপ্ন সফল হতে পারেনি; কিন্তু পুঁজিবাদেরও অন্তিম চিত্কার এখন শোনা যাচ্ছে পশ্চিমা দুনিয়ায়। ধর্মান্ধতার পতন শুরু হয়েছে সৌদি আরব থেকে। কম্যুনিজমের মতো ওয়াহাবিজমও আজ পতনের মুখে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ মৃত্যুদিবসেও সমাধি থেকে সেই ডাকই তিনি দিয়েছেন—কারণ, তার স্বপ্ন সফল করার যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। জয়তু মুজিব, জয় বঙ্গবন্ধু।