বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে এই শুল্ক কার্যকর হবে বলে সোমবার নিজের সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি এক পোস্টে জানান।
এই ঘোষণায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ব্যবসায়ীরা একে ‘বাণিজ্যিক ভূমিকম্প’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
শীর্ষ বাজারে শুল্কের ছোবল
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ৮৬৯ কোটি ডলার, যা দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ১৮ শতাংশ।
এই রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক, যার ওপর শুল্কহার এতদিন গড়ে ছিল ১৫ শতাংশ। নতুন ৩৫ শতাংশ আরোপের ফলে এই হার গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে—যা বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষমতায় বড় আঘাত হানবে।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি ও প্রস্তাব
ট্রাম্প তার চিঠিতে জানিয়েছেন,
“এই শুল্ক আমাদের দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। যদি বাংলাদেশ পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে আরও শুল্ক আরোপ করা হবে।”
তবে আলোচনার সুযোগ রেখেছেন ট্রাম্প। তার ভাষায়,
“এই সিদ্ধান্ত শতভাগ চূড়ান্ত নয়। যদি কেউ ভিন্ন কোনো প্রস্তাব নিয়ে ফোন করে এবং সেটি আমার পছন্দ হয়, তাহলে আমি তা বিবেচনা করব।”
আলোচনার টেবিলে ঢাকা
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন ওয়াশিংটনে আলোচনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ফেসবুক পোস্টে জানান,
“বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। আগামী ৯ জুলাই আরও একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি—দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।”
প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সুবিধা পাবে ভিয়েতনাম। কারণ, তারা আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি করে নিজেদের ওপর শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নিয়ে এসেছে। ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের তুলনায় তাদের পণ্য এখন ১৫ শতাংশ কম শুল্কে প্রবেশ করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ভারত ও চীন-ও এগিয়ে যেতে পারে, আর বাংলাদেশ হারাতে পারে তার দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক অবস্থান।
বেসরকারি খাত ‘অন্ধকারে’
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন,
“এই শুল্ক বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। অথচ ব্যবসায়ী মহলকে আলোচনা প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। বিদেশি ক্রেতারা বলছে—বাংলাদেশ এই বিষয়ে সিরিয়াস নয়।”
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন,
“বেসরকারি খাত বাদ পড়ে গেছে। অথচ এই খাতই সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার।”
সহযোগী খাতেও নেতিবাচক প্রভাব
শুধু পোশাক খাত নয়—এই বাড়তি শুল্কের প্রভাব পড়বে প্যাকেজিং, পরিবহন, লজিস্টিকস ও অন্যান্য সহায়ক শিল্পেও। অনেক কারখানা মার্কিন বাজারে পণ্য পাঠাতে না পেরে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হতে পারে।
সমাধানের পথ কী?
বিশ্লেষকদের পরামর্শ:
- দ্বিপক্ষীয় আলোচনার গতি বাড়ানো
- বাণিজ্যিক কূটনীতি জোরদার
- বিকল্প বাজার গড়ে তোলা (চীন, রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা)
- উচ্চমূল্যের ব্র্যান্ডেড পণ্যে জোর
- উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি
ট্রাম্প প্রশাসনের এই ঘোষণায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত মারাত্মক চাপে পড়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দ্রুত, দক্ষ ও কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি থমকে যেতে পারে এবং বহু কারখানা সংকটে পড়তে পারে।







