।। এবিএম ফজলুর রহমান।।
‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ খ্যাত কালজ্বয়ি কবিতার কবি একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ওমর আলীর আজ ৮৬তম জন্মদিন। ১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর পাবনা শহরের দক্ষিণের দুর্গম চরশিবরামপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর সদর উপজেলার পদ্মানদী তীরবর্তী কোমরপুর গ্রামের বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তবে তার পরিবার বা পাবনা কোন সংগঠন তার জন্মদিনে কোন কর্মসুচি নিয়েছে বলে জানা যায়নি।
‘সুন্দরী বাংলাদেশ পদ্ম পুকুরের ঘাটে কখনো স্নানের বেলা ঘষে মেজে পা দুখানা ধোয় দীঘল মেঘের রাশি কালো হাঁটু তার ছোয় পথ নেচে নূপুরের সুর তোলে সে যখন হাঁটে আম কাঁঠালের বনে পাখি নিয়ে দিন তার কাটে উষ্ণ খড়ের নিচে আমার বাংলাদেশ ঘুমায়।’ গ্রামীণ সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর লোকপুরাণের নিবিড়তম শিল্পান্বেষীদের মধ্যে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এবং পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ছিলেন দুটি স্বতন্ত্র ও ভিন্ন কক্ষপথের কবি-নক্ষত্র। প্রবাদপ্রতিম এই মহান দুই কবির কাব্যের বিশুদ্ধ আলোয় গা’ ভাসিয়ে উত্তরকালে এগিয়ে গেছেন অগণন শব্দভাস্কর। এক্ষেত্রে আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল-মাহমুদ, আবুল হাসান, ফজল শাহবুদ্দীন, ওমর আলীসহ অজস্র কবির নাম উল্লেখ করা যায়। তবে বাংলা-সাহিত্যের কিংবদন্তি আল-মাহমুদ আর ওমর আলী র্দীর্ঘ পরিক্রমায় সে পথের সারথি হয়েছেন বটে কিন্তু জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের মাঝামাঝি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে কবি আল-মাহমুদ নিজেই নির্মাণ করেছেন ভিন্নতর এক কবিতার জগৎ, ক্লাসিক্যাল শব্দের গৃহ। এ ক্ষেত্রে আল-মাহমুদের মতো একেবারেই ব্যতিক্রমসিদ্ধ বলয় সৃষ্টিতে কবি ওমর আলী শতভাগ সাফল্য না পেলেও তাঁর কাব্য-উদ্যান ছিল স্বকীয় বৃক্ষে ঠাসা এবং সুগন্ধি ফুলে ভরা। দ্বিধাহীনভাবেই ‘বলা যেতে পারে ওমর আলী ত্রিশের যে স্রোত ত্রিশের সীমানা পেরিয়ে ষাটেও দিব্যি প্রভাব-রাজত্ব বিরাজ করে চলছিল, ওমর আলী সে ধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা স্বতন্ত্রধারার এক কবি। যেখানে তাঁর দেশ-মাটি-মানুষই প্রধান ও আরাধ্য। তাঁর হাতেই এখান থেকে বাংলা কবিতা আর এক নতুন বাঁক পায়।’ তবে জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের কবিতার ধারাকে যে ওমর আলীর লেখা অনেক বেশি সম্প্রসারিত করেছে এ কথা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। দুজন অগ্রজ কবির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তিনি গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তা প্রাণবন্ত ও বাস্তবচিত্রে তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছেন। ‘জসিম উদ্দিনের পরেই ওমর আলীই একমাত্র কবি যিনি গভীর মমতায় গ্রাম আর গ্রামের মাটিকে কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন আপদমস্তক।’ গল্পের ঢংয়ে কবিতা বলে কবিতাকে দুর্বোধ্যতার জাল থেকে মুক্ত করার জন্যে নিরন্তর পরিশ্রম করে গেছেন তিনি। ওমর আলীর কবিতায় ‘পরিবেশ পটভূমির বর্ণনার ক্ষেত্রে পাবনার বিভিন্ন অঞ্চল প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন, ঘোষপুর, কোমরপুর, শীতলাই, রাঘবপুর, মহেন্দ্রপুর। এ ছাড়া অন্যান্য স্থানের মধ্যে শিলাইদহ, পোড়াদহ, ঈশ্বরদী, সাখটা থানা, ত্রিশাল, আতাইকুলা, ভেড়ামারা ইত্যাদি।’ ফলে তাঁর কাব্যের ভাষার মতো নায়ক-নায়িকাদের জীবনাচরণও অনাড়ম্বর এবং তাদের নাম-পদবিও গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন সালমা, রতœা, রেবা, হাসিনা, ফরিদা, রমজান আলী, গণেশ, সালাম, মালেকা, বিমলা, সূর্যভান, পরীবানু ইত্যাদি। জসীমউদ্দীনের রুপাই, আসমানী আর ডালিম গাছের মতোন ওমর আলীর কবিতার নায়ক-নায়িকা এবং সামাজিক উপাদানগুলোও সমাজবাস্তবতার মধ্য থেকেই আহরণ করে নিয়েছেন তিনি। ওমর আলীর কবিসত্তাকে জাগ্রত করেছে বাঙালীর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা অনস্তকালের লোককাহিনী, রূপকথা, বত্রিশ-পুতুলের গল্প, ভূত-প্রেতœীর গালগল্প আর চিরসজীবতায় ছাওয়া গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি-নিসর্গ। তাছাড়া আরব্য রজনীর গল্প আলিফ লায়লা, ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্র ও গোপাল ভাঁড়ের গল্পের প্রভাবও তাঁর লেখনীশক্তিকে অনেক বেশি ঋদ্ধ করেছে। কবিতায় আশ্চর্য দর্শনতত্ত¡মূলক সংলাপ আর আঞ্চলিক ভাষার সুক্ষম ব্যবহার তাঁকে দিয়েছে রাতারাতি কবিখ্যাতি। সংলাপের আশ্চার্য নৈপুণ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি আরবি ভাষার কবি কাহলিল জিবরান ও মার্কিন কবি স্টিফেন ক্রেনের আদর্শকেই অনুসরণ করেছেন এ কথা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকারও করেছেন তিনি। ওমর আলীর ‘একদিন একটি লোক’ শিরোনামের বিখ্যাত সংলাপধর্মী কবিতাটির চমকপ্রদ উপস্থাপন, সুনিবিড় অন্ত্যমিল এবং শ্লেষমাখা মানবিক ক্ষোভের দৃশ্যপট পাঠককে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে ‘একদিন একটি লোক এসে বললো ‘পারো?’ বললাম, ‘কি?’ একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে, ‘সে বললো আরো।’ ‘সে আকৃতি অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’ ‘কেন?’ আমি বললাম শুনে। সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’ (এদেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি) ওমর আলী এদেশের সাধারণ মানুষের মুখের কথাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। তাঁর মতো এতো চমৎকারভাবে আর কে বলতে পেরেছেন ‘লোকটা সুতি কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন তেজদীপ্তকণ্ঠে গর্জনসূচক ধ্বনি তুলে বলে ওঠেন ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আরেক হাতে রণতূর্য’ তখন ওমর আলী গ্রাম্যবধূর জীবন ছবি আঁকতে আঁকতে একেবারেই স্বাভাবিককণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ‘এক হাতে আঁতুর শিশু অন্য হাতে রান্নার উনুন।’ অন্যান্য কবিরা যখন সহজাতভাবেই কল্পনাপ্রবণ আর আবেগনিমগ্ন হয়ে ওঠেন তখন তিনি বাস্তবতার আঁধারে হাত বাড়িয়ে কবিতাকে ছেঁকে আনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছেন। তাঁর কবিতা পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিরচেনা গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল মানুষের জীবনের জলছবি। তাঁর এক একটা কবিতায় যেন এক একটি বাংলাদেশ! প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের চিত্রকর্মের মতো এদেশের সহজ-সরল, সাদামাটা নারীদের জীবন ছবি তিনি এঁকেছেন কবিতার তুলিতে। ওমর আলীর কবিতার বহুরৈখিক স্বর ও সামাজিক উপাদান সম্পর্কে ড. রকিবুল হাসান ‘ওমর আলীর কবিতা : ঐতিহ্যের প্রলুব্ধতা ও আধুনিকতার সম্বিৎ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘ওমর আলীর কবিতার বিষয়বস্তু গ্রামীণজীবন-সমাজ ও পরিবেশ নির্ভর হলেও, চেতনাগতভাবে বহুমাত্রিকতা আছে। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র-দেশ-কাল-অর্থনীতি-রাজনীতি সবকিছু তাঁর কবিতায় প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মাটির সঙ্গে থেকেছেন তিনি, মাটির মানুষকে স্পর্শ করে থেকেছেন। তাঁর সব কবিতাগ্রন্থ গ্রামের নিখাদ গন্ধেভরা।
গুণী এই মানুষ পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। মৃত্যুর পরের বছর ২০১৬ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। তার ৪৩টি কাব্যগ্রন্থ ও দুটি উপন্যাস রয়েছে।
ওমর আলী রোম্যান্টিক কবি যিনি ষাট দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত। তিনি তার রচিত প্রেমের কবিতাগুলোর জন্য বিখ্যাত। শ্যামবর্ণা স্বাস্থ্যবতী আদিম বাঙালি নারীকে তিনি তার সমস্ত ইন্দ্রিয় অনুভূতি দিয়ে আবিষ্কার করতে উদ্যোগী হন। তার কবিতায় গ্রাম বাংলার মাটির অকৃত্রিম সোঁদা গন্ধ মেলে। প্রেয়সীর সংস্পর্শ, মিলন ও বিরহ, অপরুপ প্রকৃতি সৌন্দর্যের রোমান্টিক অনুকল্পে তার কাব্য বাঙময় হয়ে ওঠে।।
ওমর আলী হাম্মাদিয়া হাই স্কুল থেকে ১৯৫৫ সনে প্রবেশিকা, কায়দে আযম কলেজ থেকে ১৯৬২ সনে উচ্চ মাধ্যমিক, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা থেকে ১৯৬৫ সনে স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭০ সনে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে বাঙলায় স্নাতকোত্তর করেন। পেশাগত জীবনে তিনি অধ্যাপক ছিলেন। সরকারি শহিদ বুলবুল কলেজ পাবনা থেকে ১৯৯৭ সনের ২১ অক্টোবর অবসর গ্রহণ করেন।
ওমর আলীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে, অরণ্যে একটি লোক (১৯৬৬), আত্মার দিকে (১৯৬৭), সোনালি বিকেল (১৯৬৫), নদী (১৯৬৯), নরকে বা স্বর্গে (১৯৭৫), বিয়েতে অনিচ্ছুক একজন (১৯৭৫), প্রস্তর যুগ তাম্র যুগ (১৯৭৪), স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন (১৯৭৫), তেমাথার শেষে নদী (১৯৭৪) প্রভৃতি।
লেখক : এবিএম ফজলুর রহমান, স্টাফ রির্পোটার, সমকাল পাবনা ও সাবেক সভাপতি, পাবনা প্রেসক্লাব।







